সংবাদচর্চা রিপোর্ট :
নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব শাহেদ আহম্মেদসহ দু’জনকে দুইদিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ডেমরা এলাকায় অছিম পরিবহনে আগুন দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মো. নাইমের মৃত্যুতে করা মামলায় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে দশ দিন করে রিমান্ডে আবেদন করে। শুনানি শেষে গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদ তাদের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
একই মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপিকর্মী মাহাবুবুর রহমান সোহাগ ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহম্মেদ তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
শাহেদের সঙ্গে রিমান্ডে নেওয়া অপর ব্যক্তি হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম মনির ওরফে মনির মুন্সি। দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়া সোহাগ মনির মুন্সির ব্যক্তিগত গাড়ি চালক।
এর আগে ২৫ এপ্রিল শাহেদ আহম্মেদকে নারায়ণগঞ্জের খানপুর এলাকার তার এক বন্ধুর বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন তার ভাই শাকের আহমেদ। তবে নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশ শাহেদ আহম্মেদকে আটক বা গ্রেপ্তারের বিষয় নাকোচ করেছিলেন।
এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে শাহেদসহ গ্রেপ্তার অন্যদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
সংবাদ সম্মেলন তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব পরিচালনা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার মতো জঘন্য কাজসহ অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটান বিএনপির নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর ভোরে ডেমরা থানার দেইল্লা বাসস্ট্যান্ডে রাখা অছিম পরিবহনের একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মো. নাইম (২২) ঘটনাস্থলেই পুড়ে মারা যান এবং অপর হেলপার মো. রবিউল (২৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় ২৯ অক্টোবর ডেমরা থানায় একটি মামলা (নম্বর ৩৮) দায়ের করা হয়।
তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বানচালের উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। প্রধান বিচারপতির বাস ভবনে হামলা, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করার মত জঘন্য কাজসহ অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় বিএনপির নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাতে ডেমরার দেইল্লা বাস স্ট্যান্ডে রাখা অছিম পরিবহনের একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মো. নাইম (২২) ঘটনাস্থলে আগুনে পুড়ে মারা যান এবং অপর হেলপার মো. রবিউল (২৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হন। এ ঘটনায় ২৯ অক্টোবর ডেমরা থানায় একটি মামলা করা হয়। পরে মামলাটি গত ১১ নভেম্বর সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অ্যান্টি ইলিগাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিমে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্তের প্রথমেই দুইজন ভুক্তভোগীর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত মো. নাইমের (২২) বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালি থানা এলাকায়। নাইমের বাবার নাম আলম চৌকিদার এবং মায়ের নাম পারভীন বেগম। তারা ডেমরা এলাকাতেই থাকতেন। অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়েন নাইম। অবশেষে দায়িত্ব পলন করতে গিয়ে বাসের ভেতর ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি মারা যান। অপর ভুক্তভোগী মো. রবিউল (২৫) একই বাসে নাইমের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন। আগুনের তাপে ঘুম ভেঙে যায় তার। কিন্তু ততক্ষণে তার শরীরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তিনি গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। পরে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, তদন্তভার গ্রহণের পর ঘটনাস্থলের চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ওই গাড়িটি ঘটনার দিন অগ্নিসংযোগে ব্যবহৃত হয়েছিল। এ গাড়ির সূত্র ধরে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মূল অগ্নিসংযোগকারী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার এবং ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটি জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের দেয়া তথ্যের বরাতে আসাদুজ্জামান বলেন, গত ২৮ অক্টোবরের ধারাবাহিকতা এবং নাশকতা অব্যাহত রাখার জন্য মনির মুন্সি তার নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছিলেন। নির্দেশনার মূল বিষয়বস্তু ছিল নাশকতার মাত্রা আরও বাড়ানো এবং এমন কোনো ঘটনা ঘটানো যাতে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তারই অংশ হিসেবে তিনি (মনির মুন্সি) বেশ কয়েকজনকে অগ্নিসংযোগের জন্য নিয়োগ দেন। তিনি নিজে বড় একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য তার অপর সহযোগী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিব এবং তার বন্ধু সাহেদ আহমেদকে ডেকে নেন।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই দিন রাত ২টার পর বেশ কয়েকবার ডেমরার দেইল্লা বাস স্ট্যান্ড এলাকা গাড়ি নিয়ে রেকি করেন। অবশেষে তারা কাঙ্ক্ষিত টার্গেট ফিক্সড (নির্দিষ্ট) করে বড়ভাঙা মার্কেটে চলে যান। সেখান থেকে তারা ২ লিটারের একটি পানির বোতলে পেট্রোল সংগ্রহ করেন রাত ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ঘটনাস্থলে নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার মাহাবুবুর রহমান সোহাগ গাড়িতে অবস্থান করেন এবং মনির মুন্সি ও সাহেদ পেট্রোলের বোতল নিয়ে রাস্তার পাশে পার্ক করা অছিম পরিবহনের গাড়ির কাছে যান। ড্রাইভারের সিটের পাশে থাকা খোলা গ্লাসের অংশ দিয়ে মনির মুন্সি পেট্রোল ঢেলে দেন এবং বোতলটি সেখানে ফেলে দেন। তারপর দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে পেট্রোলের উপর ছুড়ে মারেন। আগুন ছড়িয়ে পড়লে তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারীরা সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্য সড়কের রং সাইড দিয়ে ডেমরা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে সুফিয়া কামাল ব্রিজ দিয়ে ভুলতায় থাকা মনির মুন্সিদের মালিকানাধীন মুন্সি পেট্রোল পাম্পে রাত্রি যাপন করে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে তারা পেট্রোল পাম্প থেকে বাসায় চলে যান।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি সম্পূর্ণ ক্লু-লেস ছিল। আমরা বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করে ও তদন্ত করে একটি গাড়ি শনাক্ত করি। পরে সেই গাড়ির সূত্র ধরে একে একে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আগুন দেওয়ার জন্য দুই লিটারের একটি পানির বোতলে মোটরসাইকেল থেকে পেট্রোল সংগ্রহ করে, সেটিও জব্দ করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি কর্মকর্তা বলেন, মনির মুন্সি নির্দেশদাতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে এ কাজ করেন। তিনি আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। দলের আরও বড় পোস্ট পাওয়ার আশায় এ কাজ করেন তিনি।
এই ঘটনায় নির্দেশদাতাদের শনাক্ত করা হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নির্দেশদাতাদের নাম পেয়েছি। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। আমরা তাদেরও গ্রেপ্তার করব। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের বিষয়ে এখনই কোনো তথ্য আমরা বলব না।